করোনায় সৃষ্ট বেকারত্ব দূর করতে সক্ষম প্রাণিসম্পদ খাত
কৃষিবিদ ডা: মনোজিৎ কুমার সরকার
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশ। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশটি আজ উন্নয়নের জন্য সারা বিশে^র রোলমডেল। প্রাণিসম্পদ দেশের প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি উৎপাদনে বিশে^র প্রথম দশটি দেশের কাতারে দাঁড়িয়েছে। যে দেশ আমিষের জন্য অন্যদেশের উপর নির্ভর করতো আজ সেই দেশই অন্যদেশের আমিষের চাহিদা পূরণের সক্ষমতা অর্জন করছে। বিগত দেড়-দুই বছরে করোনা মহামারির কারণে শহরে বেশ কিছু শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গ্রামে শহরফেরত বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। তাছাড়া দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেকে চাকরি হারিয়ে হতাশ হয়ে পড়েছেন। কীভাবে আয় করবেন, ভেবে পাচ্ছেন না, আবার লাজ-লজ্জার ভয়ে যে কোন পেশায় হাত দিতেও সাহস পাচ্ছেন না।
সৎ ও আন্তরিকভাবে যে কোন খামার করাই লাভজনক ও সম্মানের কাজ। অল্প জমিতে বা বাড়ির সীমিত জায়গার মধ্যেই খামার স্থাপন করা যায়। এ কারণে সময় নষ্ট না করে যার যার সুবিধা মতো ও উপযোগী খামার শুরু করা উচিত।
যেসব খামার খুব সহজে ও অল্প মূলধন নিয়ে আরম্ভ করে ১ থেকে ৬ মাসের মধ্যে লাভের মুখ দেখা সম্ভব তা সারণি-১ দ্রষ্টব্য।
খামার স্থাপন বা ব্যবসায় নামার আগে যেসব বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ তা হলো-
প্রশিক্ষণ : যে ধরনের খামার স্থাপন করতে আগ্রহী সে বিষয়ে মোটামুটি প্রশিক্ষণ বা ধারণা থাকা খুব প্রয়োজন। প্রতিটি উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিস থেকে শর্ট প্রশিক্ষণ প্রদানসহ প্রযুক্তিগত সকল প্রকার সহায়তা করা হয়ে থাকে। তাছাড়াও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ওয়েভসাইটে (িি.িফষং.মড়া.নফ) ও ইউটিউব থেকে প্রাথমিক ধারণা পাওয়া যাবে।
মূলধন : ছোট আকারের খামার শুরু করতে খুব বেশি মূলধনের প্রয়োজন হয় না। ঘর তৈরি ও খাদ্য তৈরিতে সহজপ্রাপ্য ও সস্তা দেশীয় মালামাল ব্যবহার করতে হবে। ২৫ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেই শুরু করা যায়। ঋণ করেও করা যেতে পারে।
শেড নির্মাণ : পশু-পাখিকে রোদ, বৃষ্টি, ঝড়, শীত ও গরম থেকে রক্ষা করে আরামদায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য বিজ্ঞানসম্মত শেড প্রয়োজন। ভুলভাবে তৈরি করলে উৎপাদন ব্যাহত হবে। শেডে যাতে করে পর্যাপ্ত পরিমাণে আলো-বাতাস প্রবেশ করতে পারে সেটা নিশ্চিত করতে হবে। নিকটস্থ উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিস অথবা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট (িি.িফষং.মড়া.নফ) থেকে তথ্য সংগ্রহ করা যাবে।
উন্নত বাচ্চা সংগ্রহ : খামারের ধরন অনুযায়ী, স্বনাম ধন্য প্রতিষ্ঠান থেকে বিশেষ করে সরকারি হাঁস-মুরগির খামার থেকে সুস্থ সবল উন্নতমানের বাচ্চা সংগ্রহ করতে হবে। কথায় আছেÑ “ভালো বীজে ভালো ফসল”। সঠিক পদ্ধতিতে বাচ্চা পরিবহন ও প্রতিপালন (ব্রুডিং) করা বাঞ্ছনীয়। বাচ্চার ব্রুডিং কালকে (৩ সপ্তাহ) খামারের ভিত্তি বলা হয়। ভিত্তি দুর্বল হলে উৎপাদন ব্যাহত হবে।
বাচ্চার সংখ্যা অনুযায়ী স্থান, খাদ্যের পাত্র, পানির পাত্র, সরবরাহ করতে হবে। মাত্রামতো আলো প্রদান করা প্রয়োজন। খামারে পশু-পাখির কোন প্রকার সমস্যা হলো কি না তা সকাল-বিকাল পর্যবেক্ষণ করা এবং দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কথায় আছে “সময়ের এক ফোঁড় অসময়ে দশ ফোঁড়।” ষাঁড় গরু ক্রয়ের সময় ভালো লক্ষণ দেখে সুস্থ গরু হাট থেকে না কিনে বাড়ির ওপর থেকে কিনতে হবে।
খাদ্য ও পানি : খাদ্য সর্বদা পুষ্টিকর টাটকা সুস্বাদু, ভেজালমুক্ত ও ছত্রাকমুক্ত হতে হবে। দানাদার খাদ্য মিশ্রণ ফরমুলা মুরগি, হাঁস ও গরুর জন্য ভিন্ন ভিন্ন। একটি খামারে খাদ্য খরচ ৬০-৮০%, খাদ্য মানসম্মত না হলে উৎপাদন কমে যাবে। যথাসময়ে বয়স অনুযায়ী সঠিক পরিমাণে খাদ্য ও পানি সরবরাহ করা প্রয়োজন। খাদ্য হজম ও বিপাক ক্রিয়ার জন্য প্রচুর পরিমাণে পরিষ্কার নিরাপদ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
টিকা প্রদান : পশু-পাখির টিকার গুরুত্ব অসীম, সকল প্রকার সংক্রামক রোগের টিকা সঠিক বয়সে, সঠিক মাত্রায় সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে হবে। মনে রাখতে হবে “চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধ করাই উত্তম।” উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিস থেকে টিকা প্রয়োগের নির্ধারিত দিনের ১ সপ্তাহ আগেই সংগ্রহ করে রাখা ভালো। টিকা প্রদান পদ্ধতি উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিস থেকে হাতে-কলমে শেখানো হয়। গবাদিপ্রাণির ধরন অনুযায়ী টিকাসমূহ সারণি-২ দ্রষ্টব্য।
রোগবালাই : পশু-পাখি অসুস্থ হলে ব্যয় বেড়ে যাবে লাভ কমে যাবে। একেক খামারে রোগবালাই একেক রকম যেমন- মুরগির খামারে রানীক্ষেত, বসন্ত, কলেরা, গামবোরো, মানমোনেলা, সর্দি-কাশি, কৃমি, উকুন, রক্ত আমাশয় ও অপুষ্টিজনিত রোগ ইত্যাদি। হাঁসের খামারে ডাকপ্লেগ, কলেরা, হেপাটাইটিস, অপুষ্টিজনিত রোগ ইত্যাদি। কোয়েলের খামারে রক্ত আমাশয়, সালমোনেলা, রানীক্ষেত ইত্যাদি কবুতরের খামারে রানীক্ষেত, কৃমি, উকুন, ছত্রাক সংক্রমণ ইত্যাদি। গরুর খামারে ক্ষুরা, লাম্পিস্কিন, তড়কা, বাদলা, গলাফোলা, পেটফাঁপা, কৃমি, উকুন ইত্যাদি।
খামারে জৈব নিরাপত্তা ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা মেনে চলতে হবে। খাদ্য ও ওষুধ অপচয় কৌশলে রোধ করতে হবে। উপযুক্ত হলেই সরাসরি ভোক্তার নিকট বিক্রি করতে হবে। পুনরায় নতুন করে আবার শুরু করতে হবে। এভাবে খামার স্থাপনের মাধ্যমে স্বকর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। ফলে করোনায় সৃষ্ট বেকারত্ব বিমোচন হবে।
লেখক : উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসার, কাউনিয়া, রংপুর। মোবাইল : ০১৭১৫২৭১০২৬, ইমেইল : drmonojit66@gmail.com
আপডেট চলমান